মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। কত বীর মুক্তিযোদ্ধা ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের উল্লাসে মুক্ত জন্মভূমিতে স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দে উল্লসিত হয়েছেন, কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর তথা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে শামিল হতে পারেননি।
১৯৭১ সালের লাখ লাখ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন স্বাধীনতার বেদীমূলে! তারা তাদের বর্তমান উৎসর্গ করেছিলেন আমাদের ভবিষ্যৎ রচনা জন্য। ত্রিশ লাখ শহিদ কয়েক লাখ মা-বোন তাদের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন এই স্বাধীনতার জন্য।
১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো আজ আমাদের মতো প্রবীণদের স্মৃতির জানালা খুলে দিয়েছে। পেছন ফিরে তাকালে কোটি কোটি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার ছবি ভেসে ওঠে। আপন জন্মভূমি মৃত্যুগুহা হিসেবে দেখতে বাধ্য হওয়া অগণিত মানুষের অশ্রু আর রক্তের মর্মস্পর্শী সেই ঘটনাপ্রবাহ স্মৃতিকে আপ্লুত করে দেয়।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন থেকে শুরু করে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচনে বিজয় থেকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় পর্যন্ত অনন্য ঘটনাপ্রবাহ চোখের সামনে ভেসে উঠছে আজ। মনে হয় যেন সেদিনের ঘটনা! অথচ ৫০ বছর অতিক্রান্ত!
পাকিস্তান নামক ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক আর সামরিক শাসনে রাষ্ট্রের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির দুর্বার আকাঙ্ক্ষায় বাংলার মানুষের নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ ২৩ বছর যে কঠিন ত্যাগ স্বীকার আর প্রাণপণ সাহসী সংগ্রাম সেই সংগ্রামের স্মৃতি আজ আমাদের চেতনায় হয়ে দেদীপ্যমান উঠছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই সেদিনের যুবনেতা শেখ মুজিব বুঝে ফেলেছিলেন পাকিস্তানের অধীনে থাকা স্বাধীনতায় বাংলার মানুষের মুক্তি মিলবে না। তাই বলতে গেলে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই বাংলার মানুষের ওপর আঘাত আসার পর থেকে স্বাধিকারের সংগ্রাম এসে উপনীত হয় একাত্তরের সংগ্রামে।
১৯৬৬ সালেই বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন করেছিলেন স্বাধীনতার গন্তব্যে যাওয়ার। সেই সব ইতিহাস আজ সর্বজনবিদিত। স্বাধীনতার ৫০ বছর তথা সুবর্ণজয়ন্তী আর স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও পূর্ণ হলো চলতি বছরের এই মার্চেই।
তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ মহিমায় এবারের স্বাধীনতা দিবস অনন্য ঐশ্বর্যে ভাস্বর। আজ শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবী অভিনন্দিত করছে বাংলাদেশকে তার অনন্য এই দুটি চিরস্মরণীয় উৎসবকে ঘিরে। করনা মহামারির কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে আয়োজিত ১০ দিনের এই সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ-পূর্তি অনুষ্ঠান মালায় বিশ্বের অনেক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা সশরীরে যোগদান করতে পারেননি কিন্তু বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ভার্চুয়াল শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে।
একাত্তরে বাংলাদেশে যে কঠিন মূল্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, তার সোনালি ফসল আজ ঘরে তুলছে বাংলাদেশ। একদিন সাম্রাজ্যবাদীরা যে বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান ছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে অপমানের অপচেষ্টা করেছিল আজ তারাই বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে দেখার জন্য স্বল্পোন্নত ও দারিদ্র্য দেশসমূহকে পরামর্শ দিয়েছে। আজ বাংলাদেশ আপন দক্ষতায় স্বনির্ভর উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় ভূষিত বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসাধারণ নেতৃত্বে গত একযুগে বদলে গেছে বাংলাদেশ। আজ বাংলাদেশ এক দ্রুত উন্নয়নশীল বিকাশমান অর্থনীতির রাষ্ট্র।
সংগত কারণেই আজ ৫০ বছর পেরিয়ে এসে আমাদের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাবনিকাশ করা দরকার। ৩০ লাখ শহিদের রক্তস্নাত এই বাংলাদেশে যদি সর্বক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হয়ে উঠতে না পারে, তাহলে সকল আনন্দই ম্লান হয়ে যাবে। অর্জনের আনন্দ আমাদের গর্বিত করছে আজ কিন্তু আগামী দিনগুলোতে যদি উন্নয়নের এই প্রবাহ বেগবান রাখা না যায় তাহলে তা হবে লাখো শহিদের মৌন দীর্ঘশ্বাস আর আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হতাশার, যা আমরা কখনও চাই না।
মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর অতিক্রম করে আজ বাংলাদেশ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা কোনো অংশেই কম গৌরবের নয়। স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে তুলতে দিন-রাত পরিশ্রম করছেন, যখন বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় সন্তোষজনক পর্যায়ে উত্তীর্ণ যখন জাতিসংঘ, ওআইসিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সদস্যপদ অর্জন বাংলাদেশকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে তখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ভয়ংকর ধাক্কা সামলানো বাংলাদেশের জন্য এক অসম্ভব ব্যাপার ছিল বৈকি।
জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুধু বাংলাদেশকে অভিভাবকশূন্যই করা হয়নি, মুক্তিযুদ্ধের প্রগতিশীল চেতনার যে রাষ্ট্র দর্শন সেই শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রচিন্তা তাকেও হত্যা করা হয়েছে যে কারণে আবার পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় রাজনীতির উত্থান ঘটেছে যার বিষফল আজও বাংলাদেশকে ভোগ করতে হচ্ছে। উগ্র সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতা পেয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা! ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে। এর অধিকাংশ সময় কেটেছে সামরিক শাসনে। ফলে ব্যক্তিবিশেষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটলেও জনসাধারণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেনি। দরিদ্র আরও দরিদ্র হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তার কথা চিন্তাই করা হয়নি। দুস্থ দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা যেকোনো সভ্য রাষ্ট্রের জন্য অনিবার্য কর্মসূচি। কিন্তু সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে।
এই একটি ঘটনা থেকেই অনুধাবন করা যায়, প্রগতিশীল আধুনিক রাষ্ট্রদর্শন থাকলে দেশের জনসাধারণের কল্যাণ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়। গত একযুগে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে যে অকল্পনীয় সাফল্য অর্জন করেছে তা বিশ্ববাসীর কাছেও বিস্ময়। বঙ্গবন্ধু যদি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার না হতেন যদি আর দশটি বছরও বেঁচে থাকতেন, তাহলে এই বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর একটি হিসেবে গৌরবের আসন নিশ্চিত করতে পারত। কিন্তু পরাশক্তিসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দেশিবিদেশি শক্তির গভীর চক্রান্ত সেই স্বপ্ন নস্যাৎ করে দিয়েছিল জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে।
বিলম্বে হলেও আজ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ বাংলাদেশ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। কিন্তু আরও বহুদূর যেতে হবে সত্যিকারের সুখী-সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর আজীবন স্বপ্নের সোনার বাংলারূপে গড়ে তুলতে হবে। যে অর্থনৈতিক উন্নতি ইতোমধ্যে অর্জিত হয়েছে, তার সুফল আরও অধিক মাত্রায় জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছাতে হবে। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে সত্য কিন্তু তার সিংহভাগ কয়েক হাজার কোটিপতির ঘরে বৃত্তাবদ্ধ হয়েছে। দেশের অর্থ কালো টাকার মালিকরা বিদেশে পাচার করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। বিভিন্ন দেশে ‘বেগম পাড়া’র মতো অবাঞ্চিত কালো টাকার ধনীপাড়া গড়ে উঠেছে, যা কাম্য হতে পারে না।
বঙ্গবন্ধু তার সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন আজ ৪৫ বছর পরেও সে সব সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে তার কন্যা শেখ হাসিনার সরকারকেও। জাতির পিতার ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল জনসভায় বলেছিলেন-
“আজকে আমার একটিমাত্র অনুরোধ আছে আপনাদের কাছে— আমি বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যুদ্ধ করতে হবে শত্রুর বিরুদ্ধে। আজকে আমি বলব বাংলার জনগণকে— এক নম্বর কাজ হবে দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে।... আমি গ্রামে গ্রামে নামবো। এমন আন্দোলন করতে হবে যে, যে ঘুষখোর, যে দুর্নীতিবাজ, যে মুনাফাখোর, যে আমার জিনিস বিদেশে চোরাচালান দেয়, তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।... আপনারা সংঘবদ্ধ হন। ঘরে ঘরে আপনাদের দুর্গ গড়তে হবে। সে দুর্গ করতে হবে দুর্নীতিবাজদের খতম করার জন্য, বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের দুঃখমোচন করার জন্য।”
বঙ্গবন্ধু যে সংকট মোকাবিলা করতে হিমশিম খেয়েছেন, সেই সংকট ৪৫ বছর পরও বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু ওই ভাষণে করণীয় প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন, এক নম্বর হল- দুর্নীতিবাজ খতম করা দুই নম্বর হল- কলকারখানায়, ক্ষেতে-খামারে প্রোডাকশন বাড়ানো, তিন নম্বর হল- পপুলেশন প্ল্যানিং, চার নম্বর হল- জাতীয় ঐক্য।
আজও বাংলাদেশের জনসাধারণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য এই চারটি কর্ম গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় জীবনে অনেক বড় সমস্যা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর পেছন ফিরে তাকালে অনেক অর্জন আমাদের আশান্বিত করবে। কিন্তু তৃপ্ত হবার সুযোগ নেই। এখনও জাতীয় উন্নয়ন অগ্রগতিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি হীন ব্যক্তিস্বার্থ দলীয় সংকীর্ণতায় আমাদের জাতীয় ঐক্যের পথে বড় বাধা আমরা ৫০ বছর পরেও সবার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারিনি, চিকিৎসার সুযোগ বেড়েছে বটে। প্রাইভেট হাসপাতাল বেড়েছে। কিন্তু গরিব মানুষের চিকিৎসা দেয়ার সংকুচিত সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রগুলো দুর্নীতিমুক্ত নয়, চিকিৎসকদের অধিকাংশই অর্থলিপ্সায় নিমগ্ন, সরকারি হাসপাতালের চেয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা দিতে তারা অধিক আগ্রহী।
এ সংকট নিরসনের কথা ভাবতেই হবে। উপায় উদ্ভাবন করতে হবে। বিকল্প পথ তৈরি করতে হবে গরিব মানুষের কল্যাণে। শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রসার ঘটেছে সন্দেহ নেই কিন্তু শিক্ষা এখন বাণিজ্য। শিক্ষাকে মানসম্পন্ন করতে হবে সরকারি উদ্যোগ সফল হচ্ছে না, শুধু দুর্নীতির কারণে অর্থ-সম্পদে ধনী হলেও একটি জাতির সমৃদ্ধশালী হয় না, চাই শিক্ষা-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার যাতে উন্নত মানবিক গুণসম্পন্ন মানবসম্পদ সৃষ্টি হয়, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আমাদের এত সাহিত্যকর্ম খুঁজে কেন ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর মতো একটি বিশাল ক্যানভাসের বিশ্বমানের উপন্যাস আমরা পেলাম না, তা ভাবতে হবে। আমাদের শিক্ষার গলদ তথা উগ্র ভোগবাদী মূল্যবোধ থেকে বের হতে হবে মানবিক মূল্যবোধের পথ রচনা করতেই হবে যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মানুষের মতো মানুষ হিসেবে ৩০ লাখ শহিদের রক্তস্নাত এই মাটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।
লেখক: কবি, সাংবাদিক-কলাম লেখক, সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত